-বাবা তোমাকে না বলছি, আমি এখন আর এইসব ঝাল আচার খাই না, তাও কেন আনো বলো তো?
দীপক বাবু অনেক টা পথ হেঁটে আসার পরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে আধ ময়লা রুমাল টা বের করে থুতনিতে জমা ঘাম মুছতে মুছতে কাঠের সোফার হাতল ধরে বসতে বসতে বলে,
-খাস না এখন? তো কি মিষ্টি আচার খাস? আচ্ছা পরের বার মিষ্টি আচার আনবো। একটু পানি দেয় মা, গলা শুকিয়ে আসছে, ডায়াবেটিস কমে যাচ্ছে মনে হয়।
তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গিয়ে চিনির শরবত বানিয়ে আনলাম বাবার জন্য।
বাবাকে আসার সাথে সাথে এইভাবে বলার জন্য নিজেরেই খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে এখনিই কুন্তিটা গরম করে মুখে লাগিয়ে দিই। আসলে ছোট থেকে এই আচার খাওয়ার জন্য বাবাকে অনেক জ্বালিয়েছি। বাবা ক্লান্ত শরীরের ঘরে এলে আবার পাঠিয়েছি দোকানে এই আচারের জন্য।
তিন ভাইয়ের পর আমার জম্ম হয়েছিলো। বাবার জীবনের নাকি একটা মাইলফলক ছিলাম। বাবার ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘুরে গেলো। আমাদের সাধারণ জীবন আরো মসৃন হলো, প্রতি বেলায় মাছ বা মাংস থাকাটা মায়ের কাছে অনেক উন্নতির কাছাকাছি।
বাবার সাধারণ চাকরি করে তিন ছেলেকে আর মেয়েকে ভালো লেখাপড়া শেখাতে কর্পন্য করেন নি। বাবার ধারণা ছিলো অর্থ সম্পদের চেয়ে শিক্ষার সম্পদ অনেক দামী। শিক্ষা সম্পদ থাকলে অর্থশালীরাও সম্মান করবে।
বাবার আর্দশ হয়ত ঠিক ছিলো, তবে অর্থের কাছে বার বার বাবাকে পরাজিত হতে হয়েছে। শিক্ষার কাছে মাথা নুয়ে প্রতিটা ভাই বেশ উচ্চবংশীয় মেয়ে ঘরে তুলেছে। তবে বাবার তো অঢেল সম্পদ নেই, যা ছিলো তা দিয়ে এই ধরনের এক উচ্চ বংশেই আমার বিয়ে দিয়েছে। ওরা নিজেই চেয়ে এনেছে আমাকে।
বাবা ভেবেছে এরা বোধহয় ভিন্ন, বাবার আর আমার কদর করবে। তবে এরা খুব একটা খারাপ না। দুই ননদ ছিলো বিয়ে হয়ে গিয়েছে আছে শুধু জয়ন্তু, শ্বশুড় শাশুড়ী যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলে বাবার সাথে তবে এতেও যেন এদের সুক্ষ্ম অহংকার লুকিয়ে থাকে। এরা নিজেদের বিনয়ী বানিয়ে এক ধরনের লৌকিক সুখ পায়, পরবর্তীতে তাদের কথায় সেটাই বুঝা যায়।
জয়ন্তু বরাবরেই বাবাকে এড়িয়ে চলে, বাবা অধীর আগ্রহ নিয়ে ওর সাথে কথা বলতে আসলে, সে মোবাইলের ব্যস্ততায় বড্ড তাড়াহুড়াতে উঠে আসে।
আমি সব বুঝি। বাবা আর মায়ের দুইজনেরেই ডায়বেটিস, দাদারা খাওয়া আর ওষুধের দায়িত্ব নিলেও বাবার হাতে খুব সামান্য টাকায় থাকে, বাবা তো বরাবরেই অর্থ না জমিয়ে সন্তানের শিক্ষাতে তা খরচ করেছে। তাই বাবা মাঝেমধ্যেই কোন কারণ ছাড়া আমাকে দেখতে চলে আসে, লোকাল গাড়িতে করে, এতে করে বাবার পাঞ্জাবি ঘেমে উঠে, ময়লার ছাপ পড়ে, আর আসার সময় অনেক গুলো মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসতে পারে না, যা আমার শ্বশুড় মেয়ের বাড়ি যাওয়ার সময় নিয়ে যায়।
বাবা হাতে করে আমার জন্য পুরো এক প্যাকেট আচার নিয়ে আসে।
বাবা মনে করে, এই ঘরে তো সব আছে, মেয়েকে দেখতে এসে ওর পছন্দের জিনিস আনলেই তো হয়।
শাশুড়ী বাবাকে কখনো কিছু বলেন না, হেসে আপ্যায়ন করে যান, বাবা সরল মনে তাতেই খুশি হয়ে আবার আসার ইচ্ছে রাখেন।
পরে তিনি মেয়ের সাথে রসিয়ে গল্প করেন,
– কি আর বলছি শোন, আজ ও, হু, আজ ও সেই আচারের প্যাকেট নিয়েই এসেছে। বাবা বলি তার বদলে এক প্যাকেট ভালো বিস্কুট হলেও তো আনতে পারে, আমরা তো আর কিছু বলতে পারি না, মেয়ে হলেও তো বলতে পারে। বুঝি না বাবা, আমি হলে তো এমন খালি হাতে পা রাখতাম না।
শ্বশুর ও সায় দেন।
আমি শুনি, তবে বাবাকে কখনো বলতে পারি না, এইটা না এনে বিস্কুট বা অন্য ভালো কিছু এনো। না আমি পারি না, আমার গলায় যেন কিছু আটকে থাকে।
বাবাকে শরবত দিয়ে বাবার পাশে মাথা নিচু করে বসলাম, বাবা বলে,
-কি রে শরীর খারাপ নাকি? এমন শুকনো মুখ করেছিস কেন? বলছি তো পরের বার মিষ্টি আচার আনবো।
– না বাবা, তুমি আর মিষ্টি আচার এনো না। আচার এনো না।
-কেন? খেতে ভালো লাগে না এখন আর?
আমি অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি, ঝাপসা হয়ে আসছে আমার চোখের দৃষ্টি, মনে হয় জল জমেছে।
বাবা দৃষ্টি আরো অসহায়, আমার হাতে হাজার টাকা নোট টা বাবাকে দিতে গিয়ে তীব্র কাপুনি দিয়ে কাঁপছে হাত টা। বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
-পরের বার আসার সময়, এইটা দিয়ে ভালো কিছু মিষ্টি আর ফল নিয়ে এসো।
বাবার মুখ টা কিছুক্ষণ হা করে রইলো, তারপর চোখ নামিয়ে হাসলো, বাবা আমার সরল হলেও বুদ্ধিমান তো বটে। আমাকে আর কিছু বলতে হলো না। বাবা মাথা নেড়ে সব টা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো, চোখ বুলিয়ে নিলো চকচকে ঘরটাতে।
বাবাকে বললাম,
– তোমার পছন্দের ছোট মাছ রেধেছি আজ,বসো আমি রেডি করছি।
বাবা হাতে ভর দিয়ে উঠে বলল,
-আজ না রে মা, তোকে দেখতে এসেছি, দেখলাম, শরবত খেলাম, এইবার যাই।
বাবা আমার কোন আকুতি আর শুনল না, বাবা পেছন ফিরেও দেখলো না, হয়ত আমায় কিছু দেখাতে চায় না। সোফায় পড়ে থাকা এক হাজার টাকার নোট টা ফ্যানের বাতাসে পট পট আওয়াজ করে উড়ছে।
বাবা আর এইভাবে হুটহাট আসে নি, অনেক পরে ভেবে দেখলাম বাবা আর আসে নি আমাকে দেখতে। আমি কি স্বস্তি পেলাম নাকি তখন বুঝতে পারি নি৷
এর মধ্যে মা মারা গেলেন৷ বাবা আরো একা হয়ে পড়লো, আমার একটা মেয়ে হলো, যে জয়ন্তের চোখের মণি, আমার শরীরে নানা সমস্যা থাকায় আমার আর বাচ্চা হয় নি।
জয়ন্তের এই নিয়ে কোন অভিযোগ নেই, কারণ ওর মেয়েই ওর দুনিয়া।
বাবা মেয়ের খুনসুটি আবদার দেখে আমার ও মন ভরে উঠতো। বাবার কথা মনে পড়তো, বাবাকে বলতাম আমার কাছে এসে থাকতে,
বাবা হাসতো, আসে নি। তবে বাবা বড় অদ্ভুত ভাবে বলতো।
-ভাবিস না, আমি মরব না, তোর মেয়ের বিয়ে দেখে যাবো।
সত্যি আমার মেয়ে জয়ীর বিয়ে অবধি বাবা বেঁচে রইলো, জয়ন্তুর ব্যবসা প্রায় শেষের পথে, যা ছিলো তা দিয়ে মেয়ের বড় ধুমধাম করে বিয়ে দিলো। তবে জয়ন্তু যখন অভিমানের সুরে বলতো,
-জামাইর কোন কিছু অপূর্ণ রয়ে গেলো? ঠিক করে কথা বলে না কেন?
আমি বড় অদ্ভুত ভাবে হেসে বলতাম,
– আমরা যা করি প্রকৃতি তা ফিরিয়ে দেয়,
জয়ন্তু বুঝতে না পারার মতো অবাক হতো, হয়ত বুঝতো, যা উচ্চারণ করার সাহস পেতো না।
আমাকে না জানিয়ে জয়ন্তু ও প্রায় মেয়েকে দেখতে চলে যায়। একদিন ঠিক দুপুর বেলা এসে সোফায় বুক চেপে বসে রইলো, জানতে চাওয়াতে উত্তর দিলো না, শেষে বলল,
-লাবনী, মেয়েকে দেখতে গেলে কি আমাকে ভরা হাতে যেতে হবে? মেয়ের আমাকে খালি হাতে দেখে কি লজ্জা পাওয়া স্বাভাবিক? ওর জন্য তো আমি এতটা পথ যাই, ও কেন প্রতিবাদ করে নি ওর বাবাকে কেউ অপমান করলে? আমি কি কোন কিছু ভুল করে ফেলেছি শিক্ষা দিতে?
বলতে বলতে বুক চেপে ধরে জয়ন্তু। আর ঝপ ঝপ করে ঘামতে থাকি আমি। মনে হচ্ছে জয়ন্তুর জায়গায় বাবা বসে আছে, এইভাবে বুক চেপে ধরে। আর সেদিনের বাবার অবাক হওয়া চেহেরা টা কত টা কুকড়ে যাচ্ছিলো ভিতরে।
জয়ন্তুকে সে অবস্তায় ফেলে আমি ছুটলাম বাবার বাড়িতে। আমাকেই এখনিই বাবাকে বলতে হবে, বাবা তুমি আমার গর্ব, তোমাকে নিয়ে আমার কোন লজ্জা ছিলো না। আমি ভুল করে ফেলেছি তোমার অপমানে আমি প্রতিবাদ না করে নিজে লজ্জা পেতাম।
না বাবা আমার উচিত হয় নি,তোমার ছোট্ট সে পরী টাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমার উচিত ছিলো ছোট বেলার মতো জেদী হওয়ার, কেউ যেন ছুতে না পারে আমার বাবাকে।
যখন বাড়ি পৌঁছালাম। আমার বাবার কাছে আর এইসব বলা হলো না। সারা ঘরে আগরবাতির গন্ধ যেন মাথা চড়া দিয়ে উঠেছে।
এত বছর ধরে বাবার বুকে বয়ে বেড়ানো পাথর টা বাবা হাসতে হাসতে আমার বুকে তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল আর না ভাঙ্গা ঘুমে।
Be First to Comment