Press "Enter" to skip to content

কর্মজীবি মা – দোলনা বড়ুয়া তৃষা

অফিস শেষে সুমি যখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ঢুকলো, তখন সুমির শাশুড়ী জান্নাত বেগম সোফায় বসে ছিলেন সুমির মেয়ে উর্মি কে নিয়ে।
সুমি ঘরে ঢুকে সেন্ডেল খুলে টেবিল থেকে পানির গ্লাসে পানি ঢেলে পানি খেতে যাবে। তখন সুমির শাশুড়ি বলে উঠলেন,
জান্নাত বেগম- দেখো দেখো, কাজ চোর মা এসেছে। সারাদিন তো মা কোন কিছু করে নি আমাদের জন্য। এখন কি আমরা একটু নুডুলস খেতে পারবো?
সুমির মেয়ে উর্মি হেসে দাদীর সাথে সুর মিলিয়ে বলল-
উর্মি- কাজ চোর মা!
সুমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সারাদিনের অফিস রাস্তার জ্যাম ঠেলে বাসায় ঢুকে এই ধরনের কথা শুনতে হলে তখন রাগ করবে না কান্না করবে সুমি বুঝতে পারছে না।
সুমি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল। কাপড় চেঞ্জ করে রান্না ঘরে ঢুকে গেল। নুডুস বানিয়ে সুমি তার শাশুড়ী আর মেয়েকে দিলো। নিজে নিলো ওর স্বামীর জন্যেও রাখলো।
সুমি চা খেতে খেতে ওর শাশুড়ী কে বলল-
সুমি- খেতে ইচ্ছে হলে, বললেই তো হতো। ছোট মেয়ে টাকে এইসব কি শেখাচ্ছেন?
জান্নাত বেগম- আমি খারাপ শিক্ষা দিচ্ছি তোমার মেয়েকে? তাহলে ওই দুই পয়সা চাকরি ছেড়ে নিজে থাকছো না কেন মেয়েকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য?
সুমি আর কিছু না বলে রান্না ঘরে গিয়ে রান্না শেষ করল।৷ পরের দিনের জন্য সহ রান্না করে একেবারে আবার কাল এসে রান্না করবে।
কাজের মেয়ে আসে সব কাজ করে সকালে। সুমির শাশুড়ী কে কিছুই করতে হয় না। শুধু উর্মিকে একটু দেখে রাখে। তাও ঘরে ঢুকতেই শুনতে হয় সুমি কিছুই করে না। কাজ চোর। বাইরের কাজ গুলো কাজের তালিকায় থাকে না বউয়েদের।
পরের দিন সুমি এসে দেখলো ওর মেয়ে উর্মি আইসক্রিম খাচ্ছে। ঘরে ঢুকে সাথে সাথে টান দিয়ে নিয়ে ফেলল সুমি।

ওর শাশুড়ী কে বলল-
সুমি- ওকে আইসক্রিম দিয়েছেন কেন? জানেন না ওর আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লাগে সারারাত ঘুমাতে পারে না। আমাকেও জাগতে হয়।?
জান্নাত বেগমঃ ও খেতে চেয়েছে তাই দিয়েছি৷
সোফা থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন,
জান্নাত বেগমঃ নিজের আরামের ঘুমের জন্য বাচ্চার আবদার গুলো পূরণ করবে না? মা হতে গেলে কষ্ট করতে হয়। সারাদিন বাইরে বাইরে কাটালে, কীভাবে বুঝবে মা হওয়া কাকে বলে?
উনি রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন৷
উনি এমন ভাবে বললেন, যেন সে কিছুই করে নি মেয়ের জন্য কোনদিন।
উনি উঠে যেতেই উর্মি হাচি দিতে শুরু করলো। ওর ছোট থেকেই নিউমোনিয়ায় ধাচ।
রাতের রান্না শেষ করে সুমি দেখলো মেয়ের জ্বর এসেছে। কিছুই খাচ্ছে না।।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। সুমি একটু পর পর উঠে মেয়ের গা মুছে দিচ্ছে। কোলে নিচ্ছে।
এইভাবে সারারাত ঘুম হলো না সুমির। কিন্তু ওর স্বামী অন্তু নাক টেনে ঘুমাচ্ছে।
সকালের দিকে সুমির চোখ লেগে এসেছিলো, আট টার দিকে অন্তু উঠে সুমিকে ডাকলো,
অন্তুঃ এখনো নাস্তা রেডি কর নি?
সুমিঃ সারারাত ঘুমাতে পারি নি। আর একটু রেস্ট না নিলে অফিসে কাজ করতে পারব না। তুমি একটু রেডি কর না। মাকে বল। আর যাওয়ার আগে মেয়ের জন্য ওষুধ এনে দিও৷
অন্তু- সব আমি করলে তুমি করবে কি? মায়ের কিছু দায়িত্ব তুমিও পালন কর।
এইবলে অন্তু রুম থেকে বের হয়ে গেল। অন্তু রান্না ঘরে গিয়ে নাস্তা রেডি করছিলো। ওর মায়ের গলা ভেসে এলো।

জান্নাত বেগম- চাকরি করা মেয়েরা না মা হয়৷ না বউ। এরা হয় শুধু কাজ চোর।
এমন কথা শুনে সুমি আস্তে করে উঠে রান্না ঘরে গেলো। সব কাজ শেষ করে মেয়েকে একটু খাইয়ে ওষুধ খাওয়ালো৷ অন্তু রেডি হয়ে বের হয়ে গেল। সুমি তখনো বের হতে পারে নি। উর্মি সুমির কোলে উঠে বসে আছে। কিছুতেই নামছে না।
কোন মতে ওর শাশুড়ীর কোলে দিয়ে বের হচ্ছিলো। উর্মি কান্না করছে। সুমির শাশুড়ী বলছে,
জান্নাত- না না, কান্না করে না। মা তো ভালো না। পচা। তোমাকে অসুখে রেখে চলে যাচ্ছে। দেখ না মা কাজ চোর।
উর্মি তাও কান্না করছে। সুমির বুক ফেটে যাচ্ছে মেয়ের কান্নায়। কিন্তু সে কর্মজীবী মা। তাকে তো যেতে হবে।
এইভাবে বাসায় ফিরেও মেয়েকে কোলে নিয়ে নিয়ে কাজ করে সুমি। জ্বরে সারারাত জেগে থাকতে হয়। আবার সকালে উঠে ছুটতে হয়।
সুমির ক্লান্ত শরীর আর চোখের নিচের কালি কারো চোখে পড়ে না।
সবার শুধু একটায় কথা, সে কর্মজীবি মা। সে কাজ চোর মা।
বেশ কিছু দিন পর৷ এক ছুটির দিনে সুমি তার মেয়েকে পড়াচ্ছে ওখানে ওর শাশুড়ী ও ছিলো। তখন অন্তু এসে বলল,
অন্তুঃ তুমি বাসা ভাড়া টা দাও নি এখনো? জমিদার ফোন দিলো।
সুমিঃ না, তুমি দিয়ে দাও।

অন্তুঃ কেন?
সুমিঃ আমি তো দুই পয়সা ইনকাম করি। তা আর কি কাজে লাগে। তাই ভাবছি আর কাজে লাগাবো না। ঘরে বসে মেয়েকে দেখবো তাই আগে থেকেই আমি যা যা খরচ করি তা বন্ধ করছি। তোমাকে আর তোমার মাকে তো জানানো উচিত আমি কিসে কিসে খরচ করি আমার দুই পয়সার ইনকাম?
অন্তু ঃ তুমি তো জানো আমার লোন আছে। তা কেটে নেয় । আর ঘর ভাড়া দিয়ে দিলে অন্য খরচ হবে কি করে?
সুমি এইবার অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল,
সুমি- মা কি জানে আমি ঘর ভাড়া দিই? তুমি লোন কেন নিয়েছো?
অন্তু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল,
সুমি – ওর শাশুড়ী দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই বাসা ভাড়া টা দিই। আর আপনার ওষুধ খরচ ও। কিন্তু তা আপনি জানেন। জেনেও না জানার ভান করেন। আপনার ছেলে লোন নিয়েছে আপনার অপারেশন এর জন্য। তাই অর্ধেক বেতন কাটে।তখন যদি আমি টাকা না দিতাম আপনার ছেলে কোন বেতনেই পেত না তিন বছর।
আমরা দুজনে কাজ করি, ইনকাম করি যাতে আমাদের ঘর টা আরো ভালো ভাবে চলে। কিন্তু আপনি তো আমার কাজ টাকে কাজ মানেন না।আমার শরীরের ক্লান্তিকে ক্লান্তি মানেন না। আমাকে সারাদিন ঘরে বসে রান্না না করার জন্য কাজ চোর ডাকেন।
আপনার ছেলেও বাইরে কাজ করে আসে ওকে তো ডাকেন না কাজ চোর। আমি মা বলে আমি কাজ চোর মা?
আমি যদি কাজ না করতাম আমার মেয়েকে বা আপনাকে অসুস্থ হলে আমি হসপিটালে ভর্তি করাতে পারতাম না। আমি যদি কাজ না করতাম এই যে বসে আছেন দামী সোফা,আসবাব এইগুলো ঘরে শোভা পেত না।
জান্নাত বেগম মাথা নিচু করে বসে আছেন। উনি নিজের ভুল বুঝতে পরেন । তখন সুমির মেয়ে উর্মি বলে উঠলো,
উর্মি- মা কাজ চোর না। মা তো সুপার হিরো।
তখন ওর শাশুড়ী ওকে কোলে নিয়ে বলল।
জান্নাত- হ্যাঁ। মা কাজ চোর না। মা সুপার হিরো। আমারেই ভুল হয়েছে।
সুমি একটা হাসি দিলো তখন।
কর্মজীবি মা মানেই আলাদা শক্তি শালী মা। এরা ঘরে বাইরে সমান তালে সামলায়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো মেয়েরা বাইরে কাজ করে এসে শুনতে হয় সে ঘরে কোন কাজ করে না। তাদের সন্তানের মানুষ হয় না। কিন্তু কর্মজীবি মায়েরা যত টা পরিশ্রম করে তা সন্তানের ভালো আর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। তাদের ও আমরা সমান মূল্যায়ন আর সহযোগিতা করলে তাদের এই যুদ্ধ টা আরো সহজ আর সুন্দর হবে।
কর্মজীবি মায়েরা কাজ চোর না। কর্মজীবি মায়েরা সুপার হিরো৷

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

COPYRIGHT © 2018 | BARUA GROUP