-জেরি ভাত মুখে নিতেই মা, মা বলে ডেকে উঠল।
-কি বললে মা আবার বল তো।
-মা, মাম্মা।
ছোট দেবরের মেয়ের মুখে মা ডাক শুনে কি যে খুশি লাগছে। আবার বলো তো-
তখনি ছোট জা নেভি এসে বলল-
-এই কি বলিস? বল মেজ মা।
জেরি মা, মাম্মা, মাম্মা বলেই যাচ্ছে।
-বলো মেজ মা।
-থাক না ছোট। ডাকছে যখন ডাকুক না।
-না। ভুলটা শিখবে কেন?
-ও তো ছোট মানুষ। পরে ঠিক হয়ে যাবে৷
-না।
এই বলে মেয়েকে কোলে নিয়ে ছোট জা রুমে চলে গেলো।
বাটি হাতে বসে আছে অভয়া। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে৷ খুশিতে, অপমানে ও। তবে অপমান এই প্রথম না এই বাড়িতে।
বিয়ে হলো আট বছর। এখনো কোন বাচ্চা হলো না অভয়ার। যখন এসেছিল তখন বড় জা এর একটা ছয় মাসে মেয়ে ছিলো খুব আদর করত। দেখতে দেখতে বড় দিদির আরো দুই টা ছেলে হয়ে গেলো তবে অভয়ার কোল শূন্যই রইল।
ছোট জা এলো দুই বছর হলো বছর না ঘুরতে তাদের ঘরেও মেয়ে এলো। সবে কথা বলতে শিখছে। আজ মা ডাকল। কিন্তু –
দীর্ঘশ্বাস ফেলল অভয়া। উঠে রান্না ঘরে গেলো। সব কাজ ফেলে যায় বাচ্চা গুলো কে খাওয়াতে। এসে বাকি কাজ সারল।
ভাসুরের ছেলে মেয়ে গুলো স্কুল থেকে এলে ওদের স্নান করিয়ে খাওনোর দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে ভালোবেসে। কিন্তু সবাই এইটাই ওর কাজ বলে ধরে নিয়েছে।
কেউ তেমন কষ্ট দিয়ে কথা বলে না। তবে আফসোস করাটা যেনো সুই এর মতো লাগে।কোন কিছু হলেই বড় দি বলে উঠে –
-তুই বুঝবি না রে মেজ,নিজের বাচ্চা থাকলে ঠিকই বুঝতি আমার কষ্টটা।
তখন যেনো কান্নাটা গলায় কাটার মতো আটকে থাকে।
কেউ কিছু বলে না কারণ অয়ন খুব ভালোবাসে আমায়। কিন্তু তারপরও কিছু কথা হয়।
ভাসুর ডাক্তার, অয়ন ব্যবসা করে, ছোট দেবর ব্যাংকে চাকরি করে৷ সেদিন ভাসুর কাঠমুন্ডুতে কনফারেন্সে যাচ্ছিল। দিদি বাচ্চাকে নিয়ে বিজি ছিলো বলে আমিই শাশুড়ির ডাকে দই-চিনি নিয়ে গেলাম।
শাশুড়ি আমার হাত থেকে দই-চিনি নিয়ে ভিতরে গেলো। গিয়ে বড় দি কে ইচ্ছে মতো কথা শুনাল।
– কি বাপু। তোমার কি আক্কেল নেই কোনো? না পারলে আমায় বলতে৷ বড় বাবু বাইরে যাচ্ছে কোন আক্কেলে তুমি মেজ বউকে পাঠালে শুভ কাজে?
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম শাশুড়ি নিজেই এসে খাইয়ে দিলো।
ভাসুর যাওয়ার সময় বলল-
-মা এইসব না করলে পারতে। বেচারী মেয়েটা কষ্ট পেলো।
ওনাকে কিছু বলল না মা। কিন্তু বাবা যখন বলল,
– শুধু শুধু তুমি ঝামেলা করো।
তখন মা বলে উঠল-
-আমি কি করেছি? এই মেয়েকে কিছু বলেছি? আমার ছেলের ভালো খারাপ আমি না দেখলে তোমার মেজ বউ বুঝবে বুঝি?
রাতে অয়নের বুকে শুয়ে আছি।
-এই জানো?
-কি?
-আজ জেরি আমাকে মা ডেকেছে!
অয়ন কিছু বলল না। কারণ ও জানে এখন কথা বললে কথায় কথা বাড়বে৷ সব শেষে কান্না। আর ভাল লাগে না এইভাবে নিজেকে কষ্ট পেতে দেখতে অভয়াকে।
অয়ন চুপ করে আছে দেখে৷ অভয়া আবার মাথা রাখল। শার্টে বোতাম খুটিয়ে খুটিয়ে বলল-
-একটা কথা বলি?
-হু।
-চলো না আমরা একটা বাচ্চা দত্তক নি?
-ঘুমাও। কাল সকাল ৮ টায় ডেকে দিও।
বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো অয়ন।
-অয়ন
-হু।
-কাকীমা বলছিলো ওনার বাপের বাড়ি ওখানে নাকি এক মায়ের মন্দির আছে খুব জাগ্রত। গিয়ে মানত করলে সব মিলে।
-তো যাও৷
-তুমিও চলো না।
-না।
-তুমি কি চাও না আমাদের বাচ্চা হোক?
অয়ন কিছু না বলে ঘুমিয়ে গেলো।
কিছুদিন পর ছোট ননদ এলো। তার ৭ মাসে মেয়ে নিয়ে, সাথে ওর শাশুড়ি।
আমি দরজা খুললাম। নমস্কার করার পর আমার কোলে বাবুকে দিল রানু। ওর শাশুড়ি তখন সাফ বলে দিলো।
-তুমি কোলে নিতে না পারলে, এই বাড়ির কেউ নিতে পারলে বাপু আমায় দাও। তাও তোমার এই বৌদির কোলে দিও না আমার নাতনীকে।
রানু তখন অসহায় গলায় বলল- থাক না মা, মেজ বৌদি বাচ্চাদের পছন্দ করে।
ওনি গলায় ঠেস টেনে বললেন-
-নিজের না থাকলে ওরকম সবাই পছন্দ করে। নিজের থাকলে সবাই নিজের চিন্তা করে। তুমিও করো। যার তার হাতে বাচ্চা দিও না।
আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম –
-নাও গো। আমি তোমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করি।
যখন নাস্তা নিয়ে এলাম তখন ওনি মাকে বললেন- -আমি সত্যি ভাগ্যবান আপনাদের ঘর থেকে মেয়ে নিয়েছি।
মা বলল- একথা কেন বললেন বেইয়ান?
-আপনারা কত ভালো। এমন বউ এখনো রেখেছেন। আমি হলে বাপু অনেক আগেই বিদায় দিতাম। ছেলের আবার বিয়ে করাতাম।
আমি আর দাঁড়ালাম না। যেতে যেতে শুনলাম।
মা বলছে-
-আমার কি আর আপনার মতো কাপাল আছে যে ছেলে অক্ষরে অক্ষরে আমার কথা শুনবে? আমরা তো আর মেয়েকে জাদু শিখিয়ে পাঠায় না যে ছেলেকে বশ করবে৷
অইদিন আর বের হলাম না রুম থেকে। রাতের বেলায় যখন অয়ন এলো। তখন আমাকে চোখ মুখ ফোলা দেখে অয়ন জানতে চাইল কি হয়ছে?
অনেক জোড়াজুড়ির পর বললাম আজকের কথা।
অয়ন আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে মায়ের রুমে চলে গেলো। আমি আটকাতে পারলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে চিৎকার শুরু হলো।
-কত্ত বড় সাহস? আমার নামে আমার ছেলের কান ভরে? অন্য শাশুড়ির মতো দূর করে দিয় নি এইটাই কি আমার অপরাধ?
আরো অনেক কথা যা আমার হাজার বার শুনা হয়ে গেছে।
আর শুনব না বলে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলাম।
সোডিয়ামের আলোয় হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা যে চলে এসেছি নিজেও জানি না। সামনে কোন ব্রিজ পেলে আজই নিজেকে শেষ করব।
কিন্তু আর যেতে পারছি না। সামনে অনেক গুলো কুকুর। ঘেউ ঘেউ করছে। কুকুরে আমার ভীষণ ভয়। আজ ভয় লাগছে না কিন্তু কেনো যেনো ক্লান্ত হয়ে গেলাম। রাস্তায় ধারেই বসে পড়লাম। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
খুব ভোরে যখন আজান দিচ্ছিল। চারিপাশে হালকা আলো ফুটেছে তখন আবার কুকুরের ঘেউঘেউতে ঘুম ভাঙ্গল।
দেখলাম একটা সাদা কুকুর আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। যেনো আমায় ডাকছে। আমি উঠে দাড়ালাম।
কুকুরটা আমার শাড়ি আঁচল ধরে টানল। আজ আর ভয় লাগছে না। ওটার পিছন পিছন কিছুদুর গিয়ে দেখলাম কুকুরটা একটা ডাস্টবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতে একটা সদ্যোজাত বাচ্চা কান্না করে উঠল।
মনে হয় কাল রাতেই হয়েছে একটু আগে কেউ ফেলে গেছে।
আমি দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটা বুকে নিলাম। কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে চুপ হয়ে গেলো বাচ্চাটা।
হু-হু করে কেদেঁ উঠলাম। হে ভগবান এই তোমার কেমন বিচার? যারা বাচ্চার জন্য কেদেঁ কুল ভাসাচ্ছে তাদের তুমি শূন্য রেখেছো। আর যারা পেয়েছে তারা এই সুখ ময়লায় ফেলছে?
আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছি। তখন দেখলাম অয়ন ছুটে আসছে। চেহেরা উস্কুখুস্ক পাগলের মতো ছুটছে৷ যেন সারারাত রাস্তায় আমায় খুঁজেছে।
আমাকে দেখেই ছুটে এলো। হাপাঁতে হাপাঁতে বলল-
-পাগল হয়ে গিয়েছো? এইভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলে?
-তো?
-তো? আমার কি হবে ভাবলে না? সব তো করেছি। তুমি যখন যা চেয়েছো। বাচ্চা না হলে আমাদের তো দোষ নেই। সব ভগবানের হাতে। সময় হলে ওনিই দিবে। চলো বাড়ি চলো।
-আমাকে নিতে হলে সাথে আমার সন্তান ও নিতে হবে। এই দেখো। তুমি না বললে ভগবান সময় হলে দিবে। দিয়েছে আমাকে। আমার সন্তান।
-কি বলছো তুমি? কোথায় পেলে বাচ্চা?
-ওখানে কুড়িয়ে পেয়েছি আমার জন্যই রেখে গেছে কেউ।
-পাগল হয়েছো? কার বাচ্চা এইটা? আবার খুঁজতে এলে?রেখে দাও যেখানে পেয়েছো!
-তুমি পাগল, একদিনের বাচ্চা কেউ রাস্তায় ফেলে গেলে আবার খুঁজতে আসবে?
অয়নকে সব বললাম। ও সব শুনে বলল,
-আচ্ছা আমরা কিছুক্ষন অপেক্ষা করি। কেউ খুঁজতে না এলে দেখা যাবে।
-দেখা যাবে কি? আমার সন্তান আমি সাথে নেবো। তুমি আমায় নাও না নাও!
অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল অয়ন।
বাড়িতে অভয়া আর বাচ্চাকে নিয়ে ঢুকতেই কেমন হৈ-চৈ পড়ে গেলো।
-এমা, কার পাপ ঘরে নিয়ে এলি?
এই বাচ্চা এই ঘরে থাকলে আমরা বাচ্চা নিয়ে এই ঘরে থাকব না।
আরো অনেক অনেক কথা। খুব তো গিয়েছিলে আবার এলে কেনো?
অয়ন সবাইকে চুপ করিয়ে দিলো। তোমরা যদি অভয়াকে বাচ্চা নিয়ে থাকতে না দাও আমি এখনই বেড়িয়ে যাচ্ছি ওকে নিয়ে।
এককথায় সবাই চুপ।
বাচ্চাটার নাম রাখলাম রঙন।
–
২৫ বছর পর। আমি বেলখনিতে বসে আছি। রঙনের ছোট্ট মেয়ে পরী কে নিয়ে। বড় দি এসে বলল-
-এই মেজ, বাবু এখনো এলো না?প্রেসারের ওষুধটা আনতে বলেছিলাম।
-আসে নি দিদি। তবে আসছে বলল। ছোট দার ডাক্তারের রিপোর্ট টা আনতে গেছে বলল।
-আচ্ছা আসলে একটু ঘরে পাঠাস৷ তোর দাদা নাকি কি কথা বলবে।
-আচ্ছা।
-একটায় তো ভরসা এখন সব বুড়োবুড়ির৷ ছেলে গুলোকে সব পড়তে পাঠালাম বিদেশে পড়ালেখা করতে। সবাই বউ বাচ্চা নিয়ে ওখানে রয়ে গেলো।
তোর ছেলেটা ফিরে এলো সবার লাঠি হতে।
দে পরীকে দে দাদুর সাথে কিছুক্ষণ খেলুক।
গলি দিয়ে রঙনের গাড়ি ঢুকতেই বেলখনি থেকে ভিতরে এলাম। ততক্ষনে রঙন ঘরে এলো। মিরা ওকে পানি দিলো। সবাই রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
বড় মার প্রেসারের ওষুধ,
ছোট কাকার রিপোর্ট। অয়নের ইনসুলিন।
সবার সব বুঝিয়ে দিয়ে। ফ্রেস হয়ে আমার রুমে এলো।
মা, ও মা। খাবে না? এসো।
আমি চুপ করে থাকি। মা, ও মা।
ছেলে যতবার মা ডাকে ততবার আমি কান্না করি প্রতিদিন।
মা, ও মা। এসো।
সংগৃহিত : ফেসবুক থেকে
শিরোনাম : অভয়া
লেখিকা : দোলনা বড়ুয়া তৃষা
Be First to Comment